ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে রাজা হোক বা প্রজা হোক, আমরা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াই, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াই, যাতে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়। জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম, ধর্মমত ও সম্পদের শয়তান আমাদের মাঝখানে আসে না। এ বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মহম্মদ মফিজুল ইসলাম
ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
……………………………………………………………………………………………………..
দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মিলনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ করে যেকোনও উৎসবানুষ্ঠান।উৎসাহ-উদ্দীপনায়, শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে, প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে হৃদয়ের সবকটি দ্বার উন্মোচিত করে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে অভিব্যক্ত করতে পারে মানুষ। ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সেরকমই এক সর্বজনীন উৎসব, যার মধ্যে দেখা যায় একদিকে সংযম, আত্মত্যাগ ও শুচিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার বিনম্র প্রকাশ। অন্যদিকে, ধনী-গরীব নির্বিশেষে পারস্পরিক আলিঙ্গন-কোলাকুলি ও ঈদ মুবারক বিনিময়ের সার্থক রূপায়নে। এই ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের মানুষকে মিলনের আনন্দে পরস্পরের অন্তরঙ্গ করে তোলে।
বছরে দুটি পর্বে ঈদ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে ঈদ-উল-ফিতর এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ঈদ-উজ্-জোহা। রমজান মাসের অবসানে শাওয়াল মাসের শুভ সূচনায় অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে উদযাপিত হয় পবিত্র ঈদ-উজ্-জোহা। দ্বিতীয়টির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আরও গভীর। উভয় ঈদের পরিশেষে আছে দান ও মিলনানুষ্ঠান। ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ ‘আনন্দ’ বা ‘খুশি’।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এই উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। ঈদ-উল-ফিতর’-এ পুরো একটা মাস সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিরম্বু উপবাসে কাটাতে হয়। এই মাসটাকে বলা হয় ‘রমজান’ মাস। এটি আরবী ক্যালেন্ডার নবম মাস। এই উপবাস পালনকে বলা হয় ‘রোজা’ রাখা। এই রোজা ইসলাম ধর্মের তৃতীয় স্তম্ভ। ‘রোজা’ শব্দের অর্থ ‘উপবাস’। কলেমাতে বিশ্বাস স্থাপনের পর মানুষ আল্লাহর নৈকট্য বা সাক্ষাৎলাভ করে নামাজের মাধ্যমে। আর রোজা বা উপবাসের আগুনে মানুষের সকল কুপ্রবৃত্তিকে ভষ্মীভূত করে তাকে সদ্যজাত শিশুর মতো পবিত্র করে এবং আল্লাহতা’লার সন্তুষ্টিলাভে সাহায্য করে। সারা রমজান মাস ব্যাপী এই রোজা প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত সুস্থ মুসলমানের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
এরই মধ্যে চলে কর্মময় জীবনের নিরলস ব্যস্ততা আর কলকোলাহল। সারাদিনের সংযম, উপবাস ও আত্মশুদ্ধির পর রাত্রির স্তব্ধতা নামলে চলে কোরআন পাঠ ও শ্রবণ। চলে নিষ্ঠাভরে আল্লাহ’র নাম স্মরণ ও বিনম্রচিত্তে তার প্রতি একাগ্র ধ্যান। এক মাস ব্যাপী এরকম আত্মশুদ্ধি ও সনিষ্ঠ ধর্মাচরণের পরে বহু প্রত্যাশিত ‘শাওয়াল’ মাসের প্রথম দিনে ‘ঈদ-উল-ফিতর’-এর উৎসবানুষ্ঠান শুরু হয়। নারী- পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঈদের নিষ্কলঙ্ক চাঁদ দর্শন করে আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করে। শুচিবাস পরে নিকটবর্তী মসজিদ, ঈদগাহ বা ময়দানে সমবেতভাবে নামাজ পাঠ করে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় হৃদয় উজাড় করা বিনীত আকুতি ও গভীর শ্রদ্ধাভক্তি।
নামাজান্তে শুরু হয় মিলনোৎসব। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরকে প্রীতি ভরে আলিঙ্গন করে। হৃদয়ের স্পর্শে আত্মীয়-অনাত্মীয়, শত্রু-মিত্রের ভেদ মুছে যায়। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের, হিংসা-দ্বেষের স্থূল জৈব প্রবণতা চিরতরে মুছে যায় পারস্পরিক হার্দ্যমিলনে। গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্ব। বিশ্বভ্রাতৃত্ব। দান-ধ্যান অর্থাৎ যাকাত, ফিতরা, প্রীতি বিনিময় ও আনন্দ আহ্লাদের মধ্যে দিয়ে পরম শ্রদ্ধায় মুসলমানরা এই পরবটিকে পালন করে।
ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সর্বজনীন উৎসব। এর মর্মমূলে কেবল ধর্মাচরণই নেই, আছে ঐকান্তিক কৃচ্ছসাধন ও আত্মশুদ্ধাচরণের দুশ্চর ব্রত। আছে আল্লাহ’র কাছে নিষ্ঠাভরে আত্মনিবেদনের প্রয়াস। আছে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসায় উজ্জীবিত মহামিলনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সেজন্য ঈদ আধ্যাত্মসাধনা ও মিলনোৎসব প্রাণোন্মাদনায় অপূর্ব মহিমাময় ও তাৎপর্যমণ্ডিত। সহজ কথায়, ঈদ মূলত চিত্তশুদ্ধির উৎসব। সাম্যের উৎসব। সৌহার্দের উৎসব। মিলনের উৎসব। ভ্রাতৃত্বের উৎসব।
ইসলামের আইনগুলি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বকে উন্নীত করে। ইসলামের অনবদ্যতা এই যে, এটা বাস্তবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব দেখায়। মুসলমানরা দিনে পাঁচবার ফরজ ( বাধ্যতামূলক ) নামাজের মধ্যে দিয়ে সর্বজনীন বিশ্বভ্রাতৃত্বকে প্রদর্শন করে। আমরা যখন ঈদের নামাজ পড়ি বাস্তবে আমরা বিশ্বভ্রাতৃত্ব দেখাই। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে রাজা হোক বা প্রজা হোক, আমরা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াই, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াই, যাতে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়। জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম, ধর্মমত ও সম্পদের শয়তান আমাদের মাঝখানে আসে না। এ বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার আগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আরও কিছু অবশ্য করণীয় কাজ রয়েছে। ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে সর্বপ্রথমটির নাম ‘কলেমা’। ‘কলেমা’ হল ইসলামের মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রের সংখ্যা ছ’টি। এই ছ’টি মূলমন্ত্রের উপর বিশ্বাস স্থাপনের নাম ‘ঈমান’। ‘ঈমান’ শব্দের অর্থ ‘বিশ্বাস’। ইসলাম ধর্মে কলেমাতে বিশ্বাস স্থাপন বা ঈমান আনার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ পালন করা। এটি ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ‘নামাজ’ ফারসি শব্দ। আরবিতে একে বলে ‘সালাত’। এর অর্থ বিনয়, প্রণাম (সিজদাহ) ও উপাসনা। আল্লাহতা’লার কাছে অত্যন্ত বিনয় সহকারে প্রণতিনিবেদনের মাধ্যমে উপাসনা সম্পন্ন করতে হয় বলে একে ‘নামাজ’ বলে। রমজান মাসে এশা’র নামাজের পরে ও বিতর নামাজের আগে কুড়ি রাকায়াত তারাবি নামাজ পড়তে হয়। আর এ মাসেই আছে লায়লাতুল কদর বা মহাসম্মানিত রজনী। যে রজনীতে জাগ্রত থেকে উপাসনা করলে হাজার মাস বা ৮৩ বছর ৪ মাসের উপাসনার পুন্য লাভ করা যায়।
এরপর আছে ফিতরা দান করা। প্রত্যেক ‘সাহেবে নেসাব’ বা নির্ধারিত পরিমাণ ধন সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির ওপর ফিতরা দান করা ওয়াজেব। ‘সাহেবে নেসাব’কে? যে স্বাধীন ব্যক্তির হাতে সংসারের আবশ্যকীয় ব্যয় ছাড়া সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বাহান্ন তোলা রুপা থাকে তাকেই বলে ‘সাহেবে নেসাব’। এই ‘সাহেবে নেসাব’ ব্যক্তিকে তার নিজের এবং তার স্ত্রীর পুত্র ও কন্যা প্রত্যেকের পক্ষ থেকে এমন কী যে শিশু সন্তান ঈদের নামাজের পূর্বে জন্ম গ্রহণ করল তার পক্ষ থেকে ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করতে হবে। এই ফিতরা প্রথমে দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, ফকির-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে কেননা সবার মুখে ঈদের খুশিকে ফুটিয়ে তোলাই ‘ঈদ-উল-ফিতর’ এর উদ্দেশ্য। আর এরাই এই ফিতরার প্রকৃত দাবিদার।
যাকাত দ্বীন ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ। ইসলাম যে সাম্যবাদের বাণী ঘোষণা করে— যাকাত হল তা প্রতিষ্ঠা করার বাস্তব পথ। কলেমা, নামাজ রোজা, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল মুসলমানের উপর ফরজ (অবশ্যপালনীয়)। ধনীরা দরিদ্রের মধ্যে তাদের উদ্বৃত্ত ধন থেকে এই যাকাত বিতরণ করে নিজেদের পাপমুক্ত ও পরিশুদ্ধ করেন। কেননা ‘যাকাত’ শব্দটির অর্থ হল ‘শুদ্ধিকরণ’। সহজ কথায়, যাকাত হল ইসলামের সাম্যবাদী অর্থনীতির সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন। ইসলাম বলে, যাকাত যার ওপরে ফরয হয়েছে তাকে অবিলম্বে দরিদ্রদের মধ্যে তা অবশ্যই দান করে দিতে হবে। নইলে তার মুসলমানিত্ব ও ঈমান নষ্ট হবে। নামাজ, রোজা কোনও কিছুই কবুল হবে না। তাকে ইহকালে অশান্তি ভোগ করতে হবে। আর পরকালে ভোগ করতে হবে মর্মন্তুদ নরকযন্ত্রণা। যদি প্রতিটি মানুষ যাকাত দেয়, তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র চিরতরে দূর হয়ে যাবে। একটাও মানুষ থাকবে না, যাকে ক্ষুধায় মারা যেতে হবে।
যে কোনও উৎসবের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ধর্মান্ধতা কিম্বা গোঁড়ামি ও অতিরিক্ত আড়ম্বর উৎসবের মধ্যে সাম্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের যে মহান আদর্শ তা যেন কোনওভাবেই গ্রাস না করে। বরং ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ বেড়াজাল ডিঙিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে সম্প্রসারিত হয়ে ঐক্যসূত্র গড়ে তুললে আমাদের মত বহু ধর্মের দেশে তা হবে প্রকৃত বাঁচার পথ। পরিত্রাণের পথ। পবিত্র কোরআন সেই শিক্ষাই দেয়। কেননা কোরআন কেবলমাত্র একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ নয়— কোরআন সমগ্র মানব জাতির একটি সুসংহত ও সুসংবদ্ধ জীবনবিধান। প্রার্থনা করি ঈদ সকলের ভাল কাটুক।
।। সমাপ্ত ।।