অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের দিকে ইসলামপুরের হড়হড়িয়া ছিল পান চাষের জন্য বিখ্যাত। সেই সময় এই অঞ্চলের পানের ব্যাপক চাহিদা ছিল সর্বত্র। ফলে ইসলামপুরে পানকে কেন্দ্র করেও ব্যবসা জমে ওঠে।
সংবাদ অনুক্ষণ : এই বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু ঐতিহ্যবাহী হাটের মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার ইসলামপুরের হাট অন্যতম। সরকারি নথি থেকে জানা যায় যে, ইসলামপুর হাটের সূচনা হয় ১৮৮০ সালে। যদিও এর পূর্বে ইসলামপুরের ‘চক’ এ হাট ছিল বলে কথিত রয়েছে।ইসলামপুর হাট প্রথমে সপ্তাহে একদিনই বসত সোমবারে । এবং প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসত ইসলামপুরের চকে । চকের হাটটি ছিল অধিক পুরানো।কথিত রয়েছে যে ১৭৪২সালের বর্গি আক্রমনের ভয়ে তৎকালীন কাশিমবাজারের কিছু তাঁতি ইসলামপুরের ভৈরব নদীর তীরে ‘চক’ এ এসে বসতি স্থাপন করেছিল।পরে সেই তাঁতিরাই এখনে একটি নতুন গ্রাম তৈরি করে সেখনে রেশমের বাজার গড়ে তোলে ফলে এই নতুন গ্রামের নামকরণ হয় ‘চক’ নামে । ‘চক’ একটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ বাজার৷ ফলে ইসলামপুরের চকের হাট যে অধিক পুরানো সেকথা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্ত পরবর্তীকালে বিশেষ করে ১৯৭১ থেকে ইসলামপুর হাট সপ্তাহে দুদিন (সোমবার এবং বৃহস্পতিবার) বসতে শুরু করে।ইসলামপুর হাট মুলত শস্য এবং সব্জি হাট হিসেবেই পরিচিত ছিল।সেই মুঘল আমল থেকেই ইসলামপুর এবং তার পার্শবর্তী অঞ্চল গুলি ছিল কৃষিজ উৎপাদনের পক্ষে অন্যতম ঊর্বর ভূমি।এবং এই অঞ্চল গুলি তৎকালীন সময়ের ভগবানগোলা বন্দরের পশ্চাদভূমি হিসেবে গণ্য হত।অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের দিকে ইসলামপুরের হড়হড়িয়া ছিল পান চাষের জন্য বিখ্যাত। সেই সময় এই অঞ্চলের পানের ব্যাপক চাহিদা ছিল সর্বত্র। ফলে ইসলামপুরে পানকে কেন্দ্র করেও ব্যবসা জমে ওঠে।ইসলামপুর হাট কৃষিজ শস্যর জন্য বিখ্যাত হলেও হাটে অনান্য নিত্যপ্রয়জনীয় দ্রব্যর পসরাও বসত নিয়মিত যা হাটকে সমৃদ্ধ করে তোলে।ষাট-সত্তরের দশকে ইসলামপুরে নিত্য প্রয়জনীয় দোকানপাটের সংখ্যা ছিল খুব কম।এমন কি দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় তরী-তরকারীর দোকানপাটও ইসলামপুরে তেমন ছিলনা বললেই চলে। ফলে সপ্তাহের এই দুদিনের হাটই ছিল এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভরসা । তৎকালীন সময়ে প্রত্যেক হাটে তরি-তরকারী শাকসব্জী ছাড়াও বহু দোকানদার আসতেন বিভিন্ন দ্রব্যের পসরা নিয়ে,যেমন নতুন-পুরাতন কাপড়ের দোকান, হাড়ি-কড়ায় হাতা-খুন্তি, দা-কুড়োল,ডালি-কুলো, বাঁশের তৈরী বিভিন্ন দ্রব্য প্রভৃতি। অন্যদিক কুম্ভকাররা মাটির তৈরী হাড়ি কুড়ি নিয়ে বসত।গ্রামের কৃষকরা নিয়ে আসত চাল,গম,ডাল,ও মাটির হাড়িতে করে টাটকা গুড় । মৎস্যজীবীরা আনত পাশের ভৈরব নদীর টাটকা মাছ। হাটেরই এক পাশে মাংস ব্যাবসায়ি বসত । এছাড়া কর্মকার বসত তার হাপর নিয়ে,ছুরি কাচিতে শান দেয়ার দোকান বসত।বসত ঝুরি,জিলিপি ঝালবড়ার দোকানও। চুল কাটতে বসত নাপিত।বহরমপুর থেকে আসত হাতুড়ে ডেন্টাল সার্জেন।তার কাছে পড়ত দাঁত তোলাবার লম্বা লাইন। সাধারন গ্রামীন কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পন্য গরু গাড়িতে করে আবার কেউ মাথায় করে নিয়ে হাজির হত হাটে। তৎকালীন সময়ে এই হাটই ইসলামপুর অঞ্চলের গ্রাম্য জনজীবনে প্রাণের করত।বর্তমানে ইসলামপুর তার গ্রাম্যরুপটি হারিয়ে ক্রমশ শহরের রূপ ধারন করছে।গড়ে উঠেছে নিত্য প্রয়জনীয় দ্রব্য সামগ্রীর প্রচুর দোকানপাট। ফলে হাট তার পূর্ব গৌরব এবং প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই হারিয়েছে।পূর্বে যেখানে হাটে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটত বর্তমানে সেই সংখ্যাটি কমে প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ক্রেতার অভাবে হাটে বিক্রির পরিমান কমে যাওয়ায় বিক্রেতাদের সংখ্যাও অনেকটাই কমেছে।ক্রেতা-বিক্রেতার অভাবে হাটের পরিধিও অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে।এছাড়া যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতির ফলে কৃষকরাও তাদের উৎপাদিত ফসল,ফলমূল,সব্জী ইসলামপুর হাটে না এনে সরাসরি অন্য জেলায় তথা অন্য রাজ্যে খুব সহজেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে তাদের লাভের পরিমাণ যেমন বাড়ছে অন্যদিকে পরিশ্রমও কিছুটা কমেছে।এই সমস্ত নানান করণের জন্যই ঐতিহ্যবাহী ইসলামপুর হাট তার কৌলিন্য হারিয়ে অবলুপ্তির প্রহর গুনছে।