১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর মাদ্রাজ শহরের ৪০ মাইল উত্তর পশ্চিমে তিরুতানি নামক ছোট্ট জায়গায় রাধাকৃষ্ণণ জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষেরা সর্বপল্লী নামে একটি শহরে বাস করতেন, তাই রাধাকৃষ্ণণ পরিবারের সমস্ত সদস্য তাদের নামের সামনে সর্বপল্লী নামটি ব্যবহার করতেন। তার বাবার নাম সর্বপল্লী বীরস্বামী এবং তার মাতার নাম সিতাম্মা । রাধাকৃষ্ণণের চার ভাই ও এক বোন ছিল। তিনি ছিলেন তার পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান।
ছোটবেলা থেকেই রাধাকৃষ্ণাণ একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাবা দরিদ্র ছিলেন বলেই রাধাকৃষ্ণাণ তার অর্জিত শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে নিজের বৃত্তি দিতেন। ‘তিরুতানি’ শহরে তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। ১৯০৪ সালে তিনি আর্টসে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। তিনি মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং গণিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে দর্শনকে তার প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমুর্ত পূর্বকল্পনা’।
এম. এ শেষ করার পর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ ১৯০৯ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী বক্তার পদ লাভ করেন। কলেজে থাকাকালীন হিন্দু দর্শনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যথা উপনিষদ, ভগবত গীতা, ব্রহ্মসূত্র ও শঙ্কর রামানুজ এবং মাধবের ভাষ্য তার আয়ত্তে ছিল। এছাড়াও তিনি বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন এবং পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের দর্শনগুলির সাথেও পরিচিত ছিলেন।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মাইসোরের নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি সেই সময় বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকা লিখতেন। সেই সময়েই তিনি লেখেন তার প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। দ্বিতীয় গ্রন্থ দ্য রেন অফ রিলিজিয়ান ইনকনটেম্পোরারি ফিলোজফি প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। ১৯২১ সালে তিনি ভারতবর্ষের দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ঐ পদটি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ও নৈতিক দর্শনের ‘কিং জর্জ ভি’পদ। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন সম্বন্ধে হিন্দু মতের উপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি দর্শনের অন্যান্য খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ভারতে ‘ইন্ডিয়ান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাচ্য ও প্রতীচ্য রীতি-নীতির সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদানের বিরল কৃতিত্ব রাধাকৃষ্ণণের ছিল। তাঁর প্রথম জীবনের শিক্ষা তাকে প্রাচ্যের, বিশেষত ভারতের জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই ,তিনি অতি স্বচ্ছন্দে নিখুঁতভাবে এই দুটি ঐতিহ্যকে সমন্বিত করেন এবং সংশ্লেষণের দর্শন গড়ে তোলেন ।কিন্তু তার মৌলিক বিশ্বাসের শিকড় ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীরে নিহিত। তাঁর স্বকীয় দর্শনের মূল ধারণা গুলি সাধারণভাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, বিশেষত বেদান্ত দর্শন থেকে গৃহীত। কিন্তু এই ধারণা গুলিকে পাশ্চাত্য ভাবনার আদলে উপস্থাপিত করার আগ্রহ ও কৌশল ছিল তাঁর ।তিনি প্রাচীন ও চিরায়ত ধারণা গুলিকে নূতন ভাবে অভিনব রীতিতে উপস্থাপন করেছেন বলে মনে করা হয়। –(মতামত লেখকের নিজস্ব)